অনলাইনে ব্রাউজ করার সময় নিশ্চয় বিটকয়েন এর বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছে। ইতোমধ্যেই হয়তো জেনে গেছেন বিটকয়েন কি, এটা কিভাবে তৈরি হয় এবং কিভাবে এটা লেনদেন হয়ে থাকে।
প্রতিনিয়তই খবরের শিরোনাম হচ্ছে ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি যেটা ক্রিপ্টোকেরেন্সি হিসেবে পরিচিত। এখন পর্যন্ত অসংখ্য ক্রিপ্টোকারেন্সি অনলাইন দুনিয়াতে বিরাজ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে বিটকয়েন। অবস্থাটা এমন হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বলতে এখন অনেকেই বিটকয়েনকেই বুঝে থাকেন।
ভার্চ্যুয়াল জগতে যে কারেন্সিগুলো আছে তার কিছু সুবিধা প্রযুক্তিবিদরা বলছেন এবং এসব সুবিধাগুলোরর জন্যই মূলত তরুণরা এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।
কি সেই সুবিধা?
বর্তমানে প্রচলিত কারেন্সি একটা দেশের সরকার কর্তৃক ছাপানো হয়। এটা আপনার পকেটে থাকে। হাতে লেনদেন হয়। কিন্তু ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি আপনার শার্ট বা প্যান্টের পকেটে না থাকলেও ভার্চ্যুয়াল পকেটে থাকে। অর্থাৎ আপনাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে না। বাস বা ট্রেন থেকে চুরি যাওয়ার ভয় থাকে না। বা ডাকাতি হওয়ার ভয় থাকেনা।
আপনার কাছে কতো টাকা আছে তা আশেপাশের মানুষ জানতে পারছে। আবার ব্যাংকে কতো টাকা আছে তা আপনি ছাড়া কেউ জানতে না পারলেও সরকারের কোন কর্তৃপক্ষ চাইলে জানতে পারে।
কিন্তু ভার্চ্যুয়াল জগতে আপনি ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না আপনি কতো ভার্চ্যুয়াল কারেন্সির মালিক। অর্থাৎ আপনার টাকার পরিমান গোপন থাকছে। সরকার চাইলেও তা জানতে পারবে না।
ক্রিপ্টোকারেন্সি যে পদ্ধতি মেনে তৈরি হয় তা একটা নির্দিষ্ট সংখ্যায় গিয়ে থেমে যাবে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পরিমান কারেন্সির পর আর তৈরি হবে না। তাই এর চাহিদা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। যার কারনে এর মূল্য ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
কে তৈরি করছেন এই ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি?
আমাদের দেশের মুদ্রা যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ছাপানো এবং নিয়ন্ত্রণ করা হয় ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি তেমন কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছাপায় না এবং নিয়ন্ত্রণও করে না।
ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি একজন ব্যক্তি দ্বারা তৈরি হয়। এবং তার পরিচয় কেউ জানে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যারা ভার্চ্যুয়াল কারেন্সির মালিক তাদের পরিচয় যেমন গোপন থাকছে আবার তেমনি যিনি এটা তৈরি করেছেন তার পরিচয়ও গোপন থাকছে। অর্থাৎ সবকিছু গোপনীয়তার মধ্যেই হচ্ছে।
যেমন, জনপ্রিয় ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি বিটকয়েন ২০০৯ সালে “সাতোশি নাকামোটা” নামের একজন ব্যক্তি নিয়ে আসেন। সাতোশি নাকামোটা ছদ্ধ নাম। আসলে এটা কে তৈরি করেছেন এখনো তিনি জনসম্মুখে আসেন নি।
এতো গোপনীয়তার কারন কি এবং এর ফলে কি বিপদ হতে পারে?
এখন পর্যন্ত এক কথায় বলা যায়, এর উত্তর হ্যা।
আপনি বিপদে পড়তে পারেন। এবং এর সম্ভাবনাই বেশি।
উপরের লেখা থেকে কয়েকটি দূর্বলতা হয়তো লক্ষ করছেন। এক. গোপনীয়তা। দুই. কোন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা নেই। এবং যেটা বলা হয়নি তা হলো, তিন. হ্যাকিং। আপনার ভার্চ্যুয়াল ওয়ালেট থেকে হ্যাকিং করে সমস্ত কারেন্সি হাতিয়ে নিতে পারে হ্যাকাররা।
সবাই গোপনীয়তা পছন্দ করেন। কিন্তু ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি লেনদেনের পিছনে যে গোপনীয়তা রয়েছে তা সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন, সাইবার ক্রাইমসহ বিভিন্ন অবৈধ কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
লেনদেনের ক্ষেত্রে যে গোপনীয়তার কথা বলা হচ্ছে তা আংশিক সত্য। আপনি যতক্ষণ অনলাইন দুনিয়াতে লেনদেন করছেন ততক্ষণই নিজের পরিচয় গোপন রাখতে পারছেন। কিন্তু যখনি আপনি এই ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি ভাঙ্গিয়ে প্রচলিত মুদ্রায় নিতে চাইবেন তখন আপনার পরিচয় আর গোপন থাকছে না। এবং তখনই আপনি বিপদে পড়বেন।
কিছু কিছু দেশে এটা অবৈধ। যখন বিষয়টা আর গোপন থাকছে না তখন আপনি আইনি ঝামেলায় পড়তে পারেন। আপনার জেল-জরিমানা হতে পারে।
ইতোমধ্যেই রাশিয়া, ইনডিয়া, চায়না, সুইডেন, থাইল্যান্ড ভিয়েতনামসহ বেশকিছু দেশ এই ভার্চ্যুয়াল মুদ্রাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালেই এই ধরনের মুদ্রাকে অবৈধ ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এই লেনদেন এর সাথে যারা জড়িত থাকবেন তারা বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এ পড়বেন।
আমাদের পাশের দেশ ইনডিয়াতে এই ভার্চ্যুয়াল কারেন্সিতে রয়েছে প্রচুর বিনিয়োগ। ২০১৮ সালে জানুয়ারি মাসের এক খবর থেকে জানা যায়, বিটকয়েন ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। এবং এই টাকা যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের বেশির ভাগেরই উদ্দেশ্য ট্যাক্স ফাকি দেয়া।
এই খবর থেকে আরো জানা যায়, এই বিনিয়োগের পিছনে রয়েছে রিয়েল এস্ট্যাট ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তিরা এবং স্বর্ণকার। কালো টাকা লেনদেনের মাধ্যম হিসেবেও এই ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি ব্যবহার হওয়ার শংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
ভার্চ্যুয়াল কারেন্সির আরেকটি বড় বিপদ হলো হ্যাকিং।
কয়েক বছর আগে প্রায় ৮.৫০ লাখ বিটকয়েন চুরি যাওয়ায় টোকিওতে বন্ধ হয়ে যায় মুদ্রাটির অন্যতম বড় এক্সচেঞ্জ এমটি গক্স। তখন বিটকয়েনের দাম পড়ে যায় ৩০০ ডলারে।
এবং এই বছরের শুরুতে এমনি আরেকটি খবর আসে পত্রিকায়। বিটকয়নের মতই আরেকটি ভার্চ্যুয়াল কারেন্সির তৈরিকারক হঠাৎ করেই মারা যান। এবং এর ফলে ঐ মুদ্রার লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। যাদের কাছে ঐ মুদ্রা ছিলো তারা বিপদে পড়ে যান।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা যায়, যিনি ঐ মুদ্রা তৈরি করেছিলেন তার ঠিকানা বের করে তার কম্পিউটার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ে গেছে। কিন্তু পাসওয়ার্ড না জানার কারনে সেই কম্পিউটারে তারা ঢুকতে পারছেন না। তার স্ত্রীর কাছেও ঐ কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড সে বলেনি।
শেষ পর্যন্ত যদি পাসওয়ার্ড উদ্ধার করা না যায় এবং তার কারনে লেনদেন বন্ধ হয়ে যায় তাহলে বিনিয়োগকারীরা কতো টাকার ক্ষতির সম্মূখীন হবেন তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। কারন এখানে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন তারা যেহেতু গোপনীয়তাকেই পছন্দ করেন তাই তারা হয়তো তাদের বিনিয়োগের কথা কখনোই প্রকাশ করবেন না।
এসব কারনে ভার্চ্যুয়াল কারেন্সিতে বিনিয়োগকারীদেরকে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে হয়। এবং এই অনিশ্চয়তার কারনে প্রায়ই ভার্চ্যুয়াল কারেন্সির মূল্য উঠানামা করে। ডেনমার্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিটকয়েনকে এক ভয়াবহ জুয়া বলে সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
এতো অনিশ্চয়তার মধ্যেও বিল গেটস ভার্চ্যুয়াল কারেন্সির মধ্যে আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ এবং ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেট ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।