পানামা পেপার্স লিক হওয়ার ফলে সাধারন মানুষ জানতে পারলেন পৃথিবীর ধনী এবং ক্ষমতাশালী ব্যাক্তিরা তাদের সম্পদ গোপন করে ট্যাক্স ফাকি দিয়েছেন।
এই তথ্য এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লিক হলো যারা কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখে আসছিলো।
১১.৫ মিলিয়িন ডকুমেন্টস ফাস হয়ে যায় যার সফট কপিতে ভলিউম হলো ২.৬ টেরাবাইট।
এর আগে আমরা উইকিলিকস সম্পর্কে জেনেছি। উইকিলিকস ২০১০ সালে ১.৭৩ জিবি ইনফর্মেশন লিক করেছিলো। বুঝাই যাচ্ছে উইকিলিক্স থেকে এর পরিমান কয়েক হাজারগুণ বেশি।
এখন যেটা পানামা পেপার্স নামে পরিচিত তা ছিলো পানামার মোসাক ফনসেকা নামে একটি আইন বিষয়ক সংস্থার কাছে।
এই লিক হওয়া ইনফর্মেশন থেকে জানা যায় ফনসেকার ক্লাইন্টরা ১৯৭৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত নিজেদের আয়ের সঠিক তথ্য গোপন করেছেন৷
যারা নিজেদের সম্পর্কে কোনো তথ্যই প্রকাশ করতো না সেখানে তাদের ক্লাইন্টের ইনফর্মেশন চলে যায় পৃথিবীর সাধারন মানুষের কাছে৷ আর এই ইনফর্মেশন নিয়ে এখন দুনিয়া তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।
শেল কম্পানির মাধ্যমে এই আইনী প্রতিষ্ঠান তার ক্লাইন্টকে গোপনে সেবা দিয়ে আসছে। ট্যাক্স হেভেন হিসেবে পরিচিত পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই তারা সেবা দিয়ে থাকে৷
তথ্য ফাস হওয়ার পর দেখা যায় পৃথিবীর নামকরা ব্যাক্তিরা ট্যাক্স ফাকি দিয়েছেন। এবং তাদেরকে এই কাজে সহায়তা দিয়েছে মোসাক ফনসেকা।
এই লিক হওয়া তথ্যের মধ্যে যেমন আছেন বিশ্বের অনেক নামি-দামি রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী তেমনি আছেন তারকা থেকে শুরু করে ক্রীড়াবিদরাও৷
এই তথ্য ফাস হওয়ার পর জনগণের চাপের মুখে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তার পদ থেকে সরে দাড়িয়েছেন।
অন্যদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের ঘনিষ্ঠদের অর্থের হদিস পাওয়া গেছে ফাস হওয়া তালিকায়৷
নাম আছে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরন-এর।
আর রয়েছেন আমাদের পাশের দেশ ইনডিয়ার অমিতাভ বচ্চন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের ছেলের।
খেলোয়ারদের মধ্যে নাম এসেছে আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসির৷
মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন বলেছেন পানামা পেপার্স লিক হওয়া ইনফর্মেশনে তার নামটি ভুল করে এসেছে।
অন্যদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরন নিজে সরাসরি পানামা পেপার্স স্কেন্ডাল এর সাথে জড়িত না থাকলেও তিনি বিপদে পড়েছেন তার পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অর্থ নিয়ে।
জানা যায় তার প্রয়াত পিতা ইয়ান ক্যামরন একটি অফশোর কোম্পানি খুলেছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি লভ্যাংশ পেয়েছিলেন। এটা নিয়ে তার দেশে অনেক বিতর্ক চলছে।
তিনি স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। কিন্তু তাতে এখন পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি।
বিতর্কের মধ্যেই তিনি তার আয়কর বিবরণী প্রকাশ করেছেন। তা নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
আরো জানা গেছে তিনি তার মায়ের কাছ থেকে দুই লাখ পাউন্ড পেয়েছিলেন। সেটা নিয়েও এখন সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
যেখানে ট্যাক্স হেভেন আছে সেখানে যে কেউ সে দেশের নাগরিক না হয়েও অফসোর কম্পানি বা শেল কম্পানি খোলতে পারেন।
শেল কম্পানি আইনগতভাবে বৈধ। কিন্তু শেল কম্পানি অন্য আর দশটা সাধারন কম্পানি থেকে আলাদা।
শেল কম্পানি হলো কাগুজে ব্যবসা প্রতিষ্টান। তাদের কোন বিজনেস অপারেশন নেই। তারা অন্যের টাকা গোপন রেখে বিনিয়োগ করে। কেউ জানতে পারেনা কে প্রকৃত বিনিয়োগকারী।
এখন এই যে প্রকৃত বিনিয়োগকারীকে গোপন রাখা হচ্ছে এটাও সেই দেশের আইনে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। যার ফলে শেল কম্পপানিগুলো প্রকৃত বিনিয়োগকারীর নাম পরিচয় গোপন রেখে কাজ করতে পারে।
এই শেল কম্পানিগুলোতে মূলত কাজ করেন লইয়ার, অ্যাকাউনটেন্টসহ বিভিন্ন পেশার এক্সপার্টরা।
এখন তাহলে দেখা যাচ্ছে সেখানে শেল কম্পানি বা অফসোর কম্পানি খোলা বৈধ, পরিচয় গোপন রাখার আইনী সুরক্ষা রয়েছে।
এর বাইরে সবচেয়ে যে আকর্ষণীয় বিষয়টি রয়েছে তা হলো এখানে ট্যাক্সের পরিমান খুবই কম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একদম না থাকার মতই।
তাই এই সব অঞ্চল অফসোর আইল্যান্ড ট্যাক্স হেভেন নামে পরিচিত।
যেহেতু সেসব দেশে আইনি বিধি-নিষেধ তেমন নেই বললেই চলে তাই সেদেশে এই ধরনের বিনিয়োগ অপরাধ নয়।
তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে যারা সেখানে বিনিয়োগ করেছেন তাদেরকে নিয়ে কেন এতো সমালোচনা হচ্ছে? কেন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তার পদ থেকে সরে যেতে হয়েছে? এবং কেনইবা তারা নিজেদের বাচানোর জন্য বিবৃতি দিচ্ছেন?
এর কারন হলো বিনিয়োগকারী যে দেশের নাগরিক সেদেশের কর কর্তৃপক্ষের কাছে সেটা অবৈধ হতে পারে যদি তিনি সেই বিনিয়োগের কথা গোপন রাখেন৷
আর এখন পর্যন্ত যে ইনফর্মেশন লিক হয়েছে তাতে বুঝা যাচ্ছে যাদের নাম এসেছে তারা তাদের আয় গোপন করে ট্যাক্স ফাকি দিয়েছেন।
মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ট্যাক্স ফাকি দেওয়া।
আর যদি কেউ ট্যাক্স ফাকি না দিয়ে থাকেন এবং তিনি তার দেশের ইনকাম ট্যাক্স কর্তৃপক্ষের কাছে ইনকাম গোপন না করে থাকেন তাহলে তাকে দুষারোপ করা যাবেনা।
যেমনটা বলে আসছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেবিড ক্যামরন। তিনি বলেছেন, তিনি তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া ইনকামের উপর ট্যাক্স দিয়েছেন।
যদি প্রকৃতই তিনি ট্যাক্স দিয়ে থাকেন তাহলে তিনি বেচে যাবেন। কিন্তু অন্যরা? তাদের নিজেদের দেশের আইন অনুযায়ী বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেন তারা বিভিন্নভাবে এই অবৈধ অর্থ বৈধ করার চেষ্টা করে থাকেন। পানামা পেপার্স স্কেন্ডাল হলো তার একটি উদাহরন।
কিন্তু যারা এই ট্যাক্স হেভেনের সুবিধা এতোদিন ধরে নিয়ে আসছিলেন তারা হয়তো আর বেশিদিন এই সুবিধা পাবেন না। কারন ইতোমধ্যেই এই ট্যাক্স হেভেন নিয়ে পৃথিবির উন্নত দেশগুলো সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
যেমন এতোদিন ধরে ব্রিটেনের অধীন যেসব ক্ষুদ্র অঞ্চল এই ট্যাক্স ফাকি দেওয়ার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়ে আসছিলো সে সব অঞ্চলে প্রত্যক্ষ শাসন জারির দাবি উঠেছে।
আর এদিকে ফ্রান্স জানিয়েছে ট্যাক্স ফাকির এই অভিযোগের পর তারা পানামাকে কালো তালিকাভুক্ত করতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে আমেরিকা পানামা পেপার্স স্কেন্ডালের পূর্বে থেকেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে আসছিলো।
পৃথিবী জুড়ে অনেক দিন ধরেই বড় মাথা ব্যথার কারন হলো জঙ্গীবাদ। এই জঙ্গীবাদ ঠেকানোর জন্য তাদের অর্থের যোগান বন্ধ করতে চাচ্ছেন পশ্চিমারা।
তাই নতুন করে যখন পানামা পেপার্স স্কেন্ডাল হলো তখন এই ইস্যুটা আরো জোড়ালো হয়ে উঠেছে।
আর মানি লনডারিং প্রতিরোধ করার জন্যও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের আইন তৈরি হচ্ছে।
এই সব কারনে ভবিষ্যতে ট্যাক্স হেভেন অপব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়বে।
পানামা পেপার্স স্কেন্ডালের পর মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির বিরুদ্ধেও ট্যাক্স ফাকির অভিযোগ উঠেছে।
মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিগুলো যেহেতু বহু দেশে বিজনেস করে থাকে তাই তারা যেখানে ট্যাক্সের পরিমান বেশি সেখান থেকে তারা বিভন্নভাবে ইনকাম ডাইভার্ট করে যে দেশে ট্যাক্সের পরিমান কম সেখানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
এই কাজটা করে তারা আইনের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে। আইন ভঙ্গ করে নয়।
কারন আইন ভঙ্গ করলে অনেক সময়ই কম্পানির টিকে থাকার উপর হুমকি চলে আসে। অর্থাৎ কম্পানির অপারেশন সেদেশের সরকার বন্ধ করে দিতে পারে।
বন্ধ না করলেও অভিযোগ উঠলে বছরের পর বছর ধরে তৈরি হওয়া কম্পানির সুনামও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
তবে মাল্টিন্যাশনাল কম্পানি যে আইন ভঙ্গ করে না তা নয়। অতীতে আইন ভঙ্গ করে তাদেরকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতেও দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা অর্থ বিনিয়োগ করেন মুনাফার জন্য। তিনি তার দেশে মুনাফা নিয়ে যেতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু আইন যদি খুবই জঠিল হয় এবং সরকারী অফিসে বছরের পর বছর ঘুরতে হয় সেই মুনাফা রেমিট করার জন্য তাহলে ব্যবসায়ীরা বিকল্প চিন্তা করবেই।
প্রতিবন্ধকতা দূর করে যোগপযোগী আইন তৈরি করে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতে হবে সেদেশের সরকারকে যাতে করে ট্যাক্স ফাকির বিষয়টা না আসে।