অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই নেতিবাচক।
থমকে গেছে অর্থনীতি।
বছরের শেষ দিকে এসে এমন খবরই মিডিয়াতে এসেছে।
একের পর এক ঘটেছে বালিশ কান্ড, পর্দা কান্ড, পেয়াজ উর্দ্ধমূখী, পেয়াজের তেলেসমাতির মধ্যেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে লবন উধাও হয়ে যাওয়ার খবর। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দোকান থেকে লবন উধাও হয়ে যায়। ৩০-৩৫ টাকা কেজির লবন নিমিষেই উঠে যায় ১০০ টাকার কাছাকাছি। তবে সাথে সাথেই এই গুজব আবার বন্ধ হয়ে যায়।
গুজব, দূর্নীতি, খাদ্য দ্রব্যের উর্দ্ধগতি চলেছে বছর জুড়েই।
এর বাইরে রপ্তানিতে ধস, রাজস্ব আদায় কম, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, আমদানি হ্রাস, নাজুক ব্যাংক খাত, পুজিবাজারের বেহাল অবস্থা ইত্যাদি কারনে মিডিয়াতে খবর বের হয়েছে অর্থনীতির অবস্থা ভালো না।
পোশাক রপ্তানি
জুলাই-নভেম্বর সময়ে প্রায় ১,৫৭৭ কোটি ডলার রপ্তানি হয় আর গত বছর একই সময় ছিলো ১,৭০৭ কোটি ডলার। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, ৬০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের উপায় দেখছেন একমাত্র ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমিয়ে।
তবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এ সম্ভাবনা নেই। দরকার হলে সেক্টর হিসেবে আলাদা প্রণোদনা দেওয়া হবে যেটা ইতোমধ্যেই পেয়ে আসছে পোশাক খাত।
যে সব সূচক নিয়ে খবর বের হয়েছে তার বেশির ভাগই হলো রপ্তানি নিয়ে, যা বৈদেশিক মুদ্রার সাথে জড়িত। সবচেয়ে বেশি কথা বলা হচ্ছে পোশাক খাত নিয়ে। পোশাক রপ্তানি নিন্মমূখী। বেশির ভাগ অর্ডার চলে যাচ্ছে ভিয়েতনাম এবং পাশের দেশ ইন্ডিয়ায়।
এটা নতুন কিছু না। গত কয়েক বছর ধরে অনুমান করা হচ্ছিলো আমাদের প্রতিযোগি হবে সবার আগে ভিয়েতনাম। এবং এর পর ইন্ডিয়া।
মূলত, খরচের কারনেই ক্রেতারা বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায়। যেখান থেকে কম খরচে তারা কিনতে পারবে সেখানেই যাবে। চায়না দীর্ঘ সময় ধরে পোশাক রপ্তানিতে রাজত্ব করেছে। তাদের দেশের জিডিপি ১০% উপরে ছিলো অনেক বছর। সেটা এখন কমতে কমতে প্রায় অর্ধেক-এ চলে এসেছে।
কেন?
একটা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টানা একতালে চলবে না। একটা জায়গায় গিয়ে স্থিতিশীল হয়ে যায়।
বাংলাদেশে ১০ বছর আগে অনেক কম মজুরিতেই শ্রমিক পাওয়া যেত। এখন ধাপে ধাপে মজুরি বেড়েছে। দেশের মানুষের হাতে এখন টাকা যাচ্ছে। মানুষ প্রতিনিয়ত চেষ্ঠা করে যাচ্ছে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য।
দেশের বাইরে যাচ্ছেন কাজ করতে ছেলেরা। মেয়েরা কাজ করছে পোশাক কারখানায়। তাদের ছেলেরা পড়ছে বা কাজ করছে। বাড়িতে পুল্ট্রি বা গরু-ছাগল লালন-পালন করছেন।
এসবই মানুষের হাতে টাকা এনে দিচ্ছে। তাদের এক সময়ের দৈন্য-দশা এখন আর নেই। অতএব, তাদের এখন বেশি টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশে অন্যান্য সেক্টরে বিনিয়োগ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নতুন নতুন বিনিয়োগ করে শুধু পোশাক এর উপর নির্ভরতা আস্তে আস্তে কমিয়ে আনতে হবে।
পোশাক খাত থেকে রেমিটেন্সের খবর নেতিবাচক হলেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বছর শেষে এসে সুখবর দিয়েছে।
প্রবাসীদের রেমিটেন্স
সুখবর শুধু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে এসেছে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এসেছে ৭৭১ কোটি ডলার যা গত বছরের চেয়ে ২২.৬৬% বেশি।
একমাত্র এই খাত থেকেই প্রতি বছর সুখবর বিদ্যমান থাকে। অন্য সব দিক থেকেই নেতিবাচক খবর থাকলেও কখনই আশাহত করেনি প্রবাসিরা।
কিন্তু বিদেশে যাওয়ার সংখ্যা যেমন একদিকে কমে যাচ্ছে আবার বিপরীত দিক থেকে দেশে ফিরে আসার সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ার খবর আসছে।
তার মধ্যেও রেকর্ড পরিমান রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বছর শেষে এই অংক ১৮.৫০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌছবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকাররা।
সরকার যদি উদ্যোগী হতো নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করতে এবং প্রবাসীরা যে বিশাল অংক খরচ করে বিদেশে যায় তা যদি অনেকাংশে কমিয়ে আনা যেত তাহলে প্রবাসী পরিবারগুলো আরো দ্রুত তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে পারতো।
এতে করে একদিকে যেমন পরিবারগুলো ভালো থাকতো তেমনি দেশের রেমিটেন্সের অবস্থাও ভালো হতো।
গত বাজেটে ২% করে প্রণোদনা এর পিছনে কাজ করছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ব্যাংকাররা বলছেন, এই প্রণোদনা প্রবাসীদের বেশি করে রেমিটেন্স পাঠানোতে উৎসাহ জুগাচ্ছে।
ব্যাংক খাত টালমাটাল
আইএমএফ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের কাছে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার প্রবণতা অত্যন্ত গভীর। প্রভাবশালী ও ধনী কিছু ব্যবসায়ী ঋণ ফেরত দেওয়ার কোন তাগিদই অনুভব করেন না। ওপর মহলেও তাদের ভালো যোগাযোগ রয়েছে। তারাই এখন বাংলাদেশের আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিচ্ছে।
এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একদিকে দূর্বল নজরদারি, অন্যদিকে পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের আচরণ বেপরোয়া। নিয়ম ভাঙলে এখানে শাস্তি হয় না। বরং খেলাপিদের এখানে আড়াল করে রাখা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেব মতে, সেপ্টেম্বর শেষে মন্দ ঋণের পরিমান ১,১৬,২৮৮ কোটি টাকা যা মোট ঋণ বিতরনের ১২%।
ঋণ পুনঃতফসিলের ব্যবস্থা রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে বড় বড় অংকের ঋণ পুনঃতফসিল। এর পরিমান ২৭,১৯২ কোটি টাকা। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে গত জুন পর্যন্ত ২১,৩০৮ কোটি টাকা রেগুলার করা হয়েছে। এসব হিসেবে নিলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমান দাঁড়ায় প্রায় ২.৫ লাখ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংকের প্রায় ১৮ কোটি টাকা আত্নসাতের অভিযোগে ২০১২ সালে আবু সালেক নামে এক ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। ভুলে সেই চিঠি চলে যায় জাহালম নামের এক ব্যাক্তির কাছে। দুদক এবং আদালতে সে বারবার বলার পরও আমলে নেয়া হয়নি।
২০১৬ সালে তাকে গ্রেফতারের পর থেকে ৩ বছর কারাভোগের খবর মিডিয়াতে এলে ২৮ জানুয়ারি হাই কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি রুল জারি করে। পরে গত ৪ ফেব্রুয়ারী জাহালম মুক্তি পায়। এদিকে দুদক জানায়, তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুলের কারনে এমনটা হয়েছে।
এ বছরই খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে বড় ধরনের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু বড় খেলাপিদের এখন পর্যন্ত তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় নি। মাত্র ২% জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বেসিক ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়ে যাওয়া ব্যংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা সুবিধা কমেছে এ বছর। দুর্নীতির খেসারত দিতে হলো তাদের।
ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা নিয়ে যখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তখন এ থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে ব্যাংগুলোকে একীভূত করার কথা অনেকেই বলছিলেন। আর এর মধ্যে আবার নতুন তিনটি ব্যাংকের অনুমোদন সবাইকে অবাক করেছে। অনুমোদন পাওয়া তিনটি ব্যাংক হলো, বেঙ্গল কমার্শিয়াল, পিপলস এবং সিটিজেন। তবে তারা শেষ পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহসহ বিভিন্ন নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় চূড়ান্ত লাইসেন্স পায়নি।
অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেওয়ার অভিযোগ উঠে পিপলস লিজিং এর বিরুদ্ধে। এবং এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির ০৯ পরিচালককে বহিস্কার করার হয়। ১৪ জুলাই প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক আদালতে মামলা করে। বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে আমানতকারীরা। ডিসেম্বরের মধ্যে টাকা ফেরত পেতে তারা বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী এবং গভর্নরের সাথে। কিন্তু এখনও কোন সুরাহা হয়নি।
একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সাধারন মানুষ নিজেদের টাকা হারাচ্ছে, অন্যদিকে নিজেদের পকেটের টাকা বিভিন্ন সময়ে অস্বাভাবিক মূল্য হাকিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে।
পেয়াজ, লবন ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের দাম হঠাৎ লাফিয়ে আকাশচুম্বী হয়ে যায়। এতে করে সাধারন ভুক্তারা বিপাকে পড়েন।
পেয়াজের বাজার
অক্টোবরের শেষে ইন্ডিয়া পেয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে এর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। এবং প্রতি কেজি বিক্রি হয় আড়াইশো টাকা পর্যন্ত।
দাম বেশি হওয়ায় জমি থেকে পেয়াজ চুরি হতে পারে এই ভয়ে অনেক এলাকায় জমি পাহারা দেওয়ার খবরও বের হয়েছে। তবে জমি থেকে আগাম পেয়াজ তুলে বিক্রিও করেছেন কৃষকরা।
লম্বা সময় ধরে পেয়াজের দাম উর্দ্ধমূখী থাকায় পেয়াজ খাওয়া না খাওয়া নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্ডিয়া সফরে গিয়ে পেয়াজ ছাড়া রান্না করা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং তা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিলো।
পেয়াজের দামের উর্দ্ধগতির লাগাম টেনে ধরতে বিমানে করে পেয়াজ আমদানি করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাংলাদেশে বিমানে করে পেয়াজ আসলো। সৌভাগ্যই বটে। যারা খেয়েছেন তারাও বলতে পারবেন, এই প্রথমবার বিমানে করে আনা পেয়াজ খেয়েছি!
পেয়াজের মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারি আমলা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টী দূষারোপ শুনা গিয়েছে। কিন্তু তাতে ভোক্তাদের কোন উপকার হয়নি।
বাণীজ্যমন্ত্রী বলেছেন, এটা এ অঞ্চলের বাজার সঙ্কটের কারনে হয়েছে। আর বাংলাদেশ বেশি বেকায়দায় পড়েছে ইন্ডিয়া আশ্বাস দিয়ে তা ভংগ করার কারনে।
এর আগে ২০১৭ সালে পেয়াজের দাম ১৭০ টাকায় উঠেছিলো।
যারা আগে পেয়াজের ব্যবসা করেন নি তারাও এবার উদ্যোগী হয়ে চায়না, ইজিপ্ট এবং টার্কি থেকে পেয়াজ আমদানি করেন। তাতেও তারা পেয়াজের কেজি ১০০ টাকার নিচে নামাতে পারেন নি।
২৯ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়া পেয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। ২৪ অক্টোবর মহারাষ্ট্রের নির্বাচনের পরে এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে বলে মনে করা হয়েছিলো। কিন্তু তা আর হয়নি।
এদিকে ইজিপ্ট বা টার্কি থেকে পেয়াজ আনতে সময় লাগবে ৪০-৫০ দিন। কাছের দেশ মিয়ানমারও পেয়াজের দাম দুই তিন গুণ বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে আর স্বাভাবিক হয়নি।
আমাদের ঈদের আগে প্রায়ই ইন্ডিয়া গরু রপ্তানি বন্ধ করে দিতো। এতে করে আমাদের সংকটে পড়তে হতো প্রতি বছর। পরে দেশেই গরু উৎপাদন শুরু হয়। এবং এখন সংকটের সমাধান হয়েছে।
তেমনি পেয়াজ নিয়েও ভাবতে বলছেন সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
সাধারন মানুষ যখন তাদের পরিবারের নিত্য দিনের বাজার নিয়ে টাকা জুগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচের কথা শুনলে মনেই হয়না আমাদের টাকার অভাব রয়েছে।
কয়েক টাকার কাজ হাজার টাকা, লাখ টাকায় করার খবর আসে বালিশ কান্ড, পর্দা কান্ড বা বই কান্ডের খবর শুনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ছাড়া এই খবরগুলোর তেমন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। এভাবে একের পর এক ভাইরাল নিয়ে থাকতে হয়েছে সাধারন মানুষদের।
বালিশ, পর্দা, বই
২০ ও ১৬ তলা ভবনে প্রায় ৬,০০০ টাকার বালিশ তুলতে খরচ হয়েছে প্রায় ১,০০০ টাকা। এই খরচ করেছেন পাবনার রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্রিনসিটি আবাসন প্রকল্প। কর্মীদের আবাসন প্রকল্পের খরচ হিসেবে এই টাকা দেখানো হয়েছে।
এই হিসেবের তদন্তে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুই কমিটির প্রতিবেদনেই ৬২,২০,৮৯,০০০ টাকার অনিয়ম উঠে আসে।
বালিশকান্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই পর্দা কেনাকাটায় দুর্নীতির খবর বের হয়। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ রোগী আলাদা করে ঢেকে রাখার জন্য ১৬ পিসের এক সেট পর্দা কেনায় খরচ দেখানো হয় ৩৭,৫০,০০০ টাকা।
এই অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠার পর দুদক উচ্চমূল্যে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার মাধ্যমে ১০ কোটি টাকা আত্নসাতের অভিযোগে মামলা করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য ৫,৫০০ টাকার বই ৮৫,৫০০ টাকায় কেনার অভিযোগ উঠে। তবে এর জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করলেও এর অগ্রগতি জানা যায়নি।
পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমান এবং দুদক কর্মকর্তা খন্দকার এনামুল বাছিরের মধ্যে ঘূষ নিয়ে কথোপকথনের অডিও ফাস হয়ে যায়। জানা যায়, দুদক কর্মকর্তা ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন পুলিশের ডিআইজির সম্পদ অনুসন্ধানে গিয়ে।
বিভিন্ন হুমকি-ধামকি দিয়ে টাকা বের করার বা টাকা খরচ করার নজির আমরা জেনেছি। তবে গত বছর টেলিকম সেক্টরের দুই জায়ান্ট গ্রামীণ এবং রবি থেকে সরকারের দাবীকৃত টাকা বের করা যায় নি।
শেষ দিকে এসে রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিশ পাঠানোর বিষয়টি সরকারকে বিব্রত করেছে।
মোবাইল কোম্পানি
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গ্রামীণফোনের কাছে ১২,৫৭৯.৯৫ কোটি টাকা এবং রবির কাছে ৮৬৭.২৩ কোটি টাকা পাওনা চেয়ে এপ্রিল মাসে চিঠি দেয় বিটিআরসি। তবে দুই টেলিকম অপারেটরই নিরীক্ষা প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলেছে।
বিভিন্ন চাপ প্রয়োগ করেও বিটিআরসি এখন পর্যন্ত তাদের কারো কাছ থেকেই দাবিকৃত পাওনা টাকা আদায় করতে পারেনি। আর এরই মধ্যে জিপি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছে। এতে করে আরো ক্ষেপে গিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী।
এদিকে পুরো বছর ধরেই ফাইভ-জি চালুর কথা শুনা গিয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেছেন, আগামী বছর ফাইভ-জি জগতে পা দিবে বাংলাদেশ।
সারা দেশে এই সেবা সম্প্রসারনের লক্ষ্য নিয়ে ইতোমধ্যেই রোডম্যাপও তৈরি হয়েছে আবং রাষ্ট্রায়ত্ব অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমেই ফাইভ-জি সেবা শুরু হবে, বলেছেন মন্ত্রী।
অঢেল খরচ, জিনিষপত্রের উর্দ্ধগতি এবং ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের জমানো টাকা উধাও এসবই ক্ষতির পরিমান আমরা জানি। কিন্তু এ বছর কিছু দূর্ঘটনা ঘটেছে যার কারনে প্রাণহানি হয়েছে।
আবার প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারনেও প্রাণহানিসহ অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যা হয়তো কখনো টাকায় হিসেব করা যাবে না।
ক্ষয়ক্ষতি অজানা
২০১০ সালে নিমতলী অগ্নিকান্ডের পর ২০ ফেব্রুয়ারি আবার পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। এতে মারা যান ৭১ জন।
রাসায়নিক, প্লাস্টিক ও প্রসাধন সামগ্রীর কারনে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। নিমতলির আগুনও একই কারনে ভয়াবহ আকার ধারন করেছিলো। সে সময় এগুলো সড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও পরে আবার থেমে যায়।
এর পরের মাসেই ২৮ মার্চ আগুন লাগে অভিজাত এলাকা বনানীর এফআর টাওয়ারে। এ অগ্নিকান্ডে মারা যান ২৫ জন। নকশা জালিয়াতি করে অনুমোদনহীন ১৮ তলা বিল্ডিং বানানোর খবর বের হয়েছে এফআর টাওয়ারের বিরুদ্ধে।
বছরের একদম শেষদিকে ১১ ডিসেম্বর কেরনীগঞ্জের চুনকুটিয়ায় একটি প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগে। এতে মারা যান ২২ জন।
এ বছর কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কিছু যাত্রী। ২৪ জুন সিলেট থেকে ঢাকাগামী ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান ৪ জন এবং শতাধিক যাত্রী আহত হন।
১১ নভেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে মুখূমুখী সংঘর্ষে মারা যান ১৬ জন। এর কিছুদিন পরেই আবার সিরাজগঞ্জে রংপুর এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়। পাওয়ার কার ও ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়, কোন হতাহত হয়নি। ।
মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ফণী আঘাত হানে যার ফলে প্রাণহানি হয় ৯ জনের। সরকারি হিসেব মতে এতে করে ৩৮.৫৪ কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৯ নভেম্বর আবার আঘাত হানে ঘূর্ণীঝড় বুলবুল। যদিও ফণী থেকে ভয়াবহতার কথা বেশি বলা হয়েছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানার কারনে বাংলাদেশে ক্ষতির পরিমান কমে যায়। তারপরেও এতে মারা যান ২৪ জন। এতে করে ৭২,২১২ টন ফসলের ক্ষতি হয় যার আর্থিক মূল্য অনুমান করা হয় ২৬৩ কোটি টাকা।
বুলবুল ঘূর্নিঝড় চলাকালে আবহাওয়া অধিদপ্তের ওয়েবসাইটে সমস্যা দেখা যায় । এবং এ সমস্যার কারনে ১২ ঘন্টার বেশি সময় তথ্য আপডেট দিতে পারেনি।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়। এতে ২৮ জেলায় ৬০,৭৪,৪১৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন।
এই বছর ডেঙ্গুও আমাদের জন্য এক ভয়াবহ দুর্যোগ নিয়ে আসে। মানুষ এতে করে আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েন।
ডেঙ্গু আতংক
এবার মহামারি আকার ধারন করে ডেঙ্গু। হাসপাতালের ধারন ক্ষমতার বাইরে কয়েকগুণ রুগী ভর্তি হয়। অনেক হাসপাতালেই স্থান সংকুলান ছিলোনা। রুগীরা এক হাসপাতাল থেকে ছুটেছেন আরেক হাসপাতালে।
সিটি কর্পোরেশন যে ঔষধ ছিটিয়েছে তার কার্যকারিতা নেই এমন খবরও বের হয়েছে। আবার ঔষধ কেনা নিয়েও দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে।
একটা সময় মনে হয়েছে, সব কিছুই যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষ ভাগ্যের উপরই সব ছেড়ে দিয়েছেন। মশা দেখলেই মানুষ আতংকে থাকতেন। এবং এই ভয়েই বেশি থাকতেন, কখন মশা কামড়ায় এবং ডেঙ্গু হয়।
অর্থমন্ত্রী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাজেট ২০১৯-২০ অধিবেশনে যোগ দিলেও তিনি আর বাজেট উপস্থাপন করতে পারেন নি। প্রধানমন্ত্রী বাজেট পড়ে শুনান। পরে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শত্রুরও যেন ডেঙ্গু না হয়।
সে সময় মশা প্রতিরোধক কিনতে মানুষ ফার্মেসিগুলোতে হানা দেয়। এক লাফে চাহিদা থাকার কারনে অল্প টাকার প্রতিরোধক হয়ে যায় হাজার টাকার উপরে। এই নিয়ে অনেক সমালোচনা হলে ফার্মেসিগুলো বিক্রি বন্ধ করে দেয়। তখন সাধারন মানুষ আরো বেশি বিপদে পড়ে যায়।
ক্যাসিনো বাণিজ্য
বছরের শেষদিকে এসে ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার ক্লাবগুলোতে অভিযান চালানো হয়। এতে বেরিয়ে আসে রাতের আধারে ক্লাবগুলোতে চলতো ক্যাসিনো। এসবের পিছনে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কয়েকজন নেতার নাম বেরিয়ে আসে।
মূল্যস্ফীতি
চার বছর পর মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬.০৬% হয়েছে যা গত বছর ছিল ৫.৭%। ২০১৫ সালে ছিল ৬.১০%। পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন, খাদ্য খাত এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে পেয়াজের অবদান সবার উপরে। পেয়াজের দাম আড়াইশো টাকা পর্যন্ত উঠে এখন তা ১০০ টাকার আশে-পাশে ঘুরাঘুরি করছে।
রাজস্ব আদায়
রাজস্ব আদায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। চলতি অর্থ বছরে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৭৭,৮১০ কোটি টাকা। যা গত বছরের চেয়ে ৪০% বেশি। কিন্তু অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ৪% বেড়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেছেন, আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ায় রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়েছে।
ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ
জুলাই-নভেম্বর সময়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৪৭,১৩৯ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে নেয়ার কথা ছিলো ৪৭,৩৬৪ কোটি টাকা।
প্রথম চার মাস সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে ৫,৫১২ কোটি টাকা যা গত বছর একই সময়ে ছিলো ১৭,৮২৯ কোটি টাকা।
শেয়ার বাজার
২০১০ সালের পর শেয়ার বাজারের বেহাল অবস্থা আর কাটেনি। এক চতুর্থাংশ শেয়ারের মূল্য তাদের ফেইস ভ্যালুর নিচে পড়ে গেছে। আবার কিছু কোম্পানির শেয়ার মূল্য ৫ টাকারও নিচে।
ব্রেক্সিট
ইইউ নেতাদের সাথে করা চুক্তি নিয়ে বিপাকে পড়ে দায়িত্ব ছাড়েন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। পরে জুনে তার স্থলাভিষিক্ত হন বরিস জনসন। ক্ষমতায় এসে দ্রুত ব্রেক্সিট করতে চাইলে সাংসদদের চাপে পড়ে মেয়াদ বাড়াতে ইইউর কাছে চিঠি পাঠান জনসন।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে টোরি সংখ্যাগরিষ্ট সংসদে ৩১ জানুয়ারী ২০২০ এর মধ্যে ব্রেক্সিট কার্যকর করার বিলে অনুমোদন দেয়। এতে করে আপাতত ব্রেক্সিট সংকট কেটে যায়।
ইউএস-চায়না বাণিজ্য যুদ্ধ
বছরজুড়েই উত্তাপ ছড়িয়েছে ইউএস-চায়না বাণিজ্য যুদ্ধ। মে মাসে ইউএস ২০ হাজার কোটি ডলারের চায়না পণ্যে শুল্ক আরোপ করে। আগস্টে আবার ৫৫ হাজার কোটি ডলারের পণ্যে অতিরিক্ত ৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ট্রাম্প।
এর পালটা ব্যবস্থা নেয় চায়নাও। এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানে সারা বিশ্বেই ছিল উদ্বেগ।
ইন্ডিয়া-কাশ্মীর এবং নাগরিকত্ব আইন
কাশ্মীর চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাট্রিজ আর্থিক ক্ষতির পরিমান জানায় ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ১০০ কোটি ডলার। তবে এই অচল অবস্থা চলতে থাকা এখন পর্যন্ত মোট কতো ক্ষতি হয়েছে তার হিসেব পাওয়া যায়নি।
৫ আগস্ট মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে সেখানে সেনা মোতায়েন করে। রাস্তা ঘাট, দোকান-পাট বন্ধ হয়ে যায়। মোবাইল এবং ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ হয়ে যায়।
অনেকেই জানেন, কাশ্মীরের প্রধান অর্থনৈতিক খাত হলো পর্যটন। এই খাতে ব্যাপক ধ্বস নেমেছে। এর সাথে হোটেল ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা গোটানোর কথা ভাবছেন।
এই ক্ষতি শেষ হতে না হতেই মোদি সরকার পাস করে নাগরিকত্ব আইন। প্রায় ২১ কোটি মুসলিম এই আইনের ফলে বিপদ্গ্রস্থ হবেন বলে খবর বের হয়েছে।
এর বিরুদ্ধে ইন্ডিয়াজুড়ে চলছে তুমুল আন্দোলন। স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হচ্ছে।
এর ফলে কতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং এই আন্দোলন আরো কতোদিন চলবে তা বলা যাচ্ছে না। এর ধ্বাক্কা দেশের অর্থনীতিতে পড়ছে।
মোদি সরকারেরই সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্ঠা অরবিন্দ সুব্রানিয়াম বলেছেন, বিরাট মন্দার দিকে যাচ্ছে ইন্ডিয়া।
তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, আমাদের হাতে রপ্তানি, ভোগ্যপণ্য ও রাজস্ব আয়ের যে তথ্য রয়েছে, তা যদি ২০০০-২০০২ সালের মন্দাকালীন সময়ের সাথে তুলনা করি, তবে দেখা যাবে অর্থনীতির এই সূচকগুলো হয় নেতিবাচক বা উল্লেখিত সময়ের তুলনায় কমই ইতিবাচক।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, জিডিপি প্রবৃদ্ধি পর পর সাত প্রান্তিকে অব্যাহতভাবে কমেছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার ছিলো ৮%। চলতি ২০১৯-২০ অর্থ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা এসে ঠেকেছে ৪.৫%-এ।
দেশে-বিদেশে অর্থনীতির পূর্বাভাস ভালো ইংগিত দিচ্ছে না। ইন্ডিয়ার অর্থনীতি, ইউএস-চায়না বাণিজ্য যুদ্ধ, আমাদের অর্থনীতির সূচকগুলোর নিন্মমূখী প্রবণতা ইত্যাদি মিলিয়ে আগামী বছর কেমন যাবে তা নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ থাকবে।
সব উদ্বেগ কাটিয়ে আগামী বছর আমাদের সবার ভাল কাটুক এই কামনা করছি।
গুড বাই ২০১৯!
হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২০!!