জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগল -এর মালিকানাধীন ইউটিউবে উগ্রবাদী ভিডিওর পাশে বিশ্বের সব নামী ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। টাইমস পত্রিকার এক অনুসন্ধানে এমনটা বেড়িয়ে এসেছে।
এরপর একে একে ইউকে, আমেরিকার ঐসব ব্র্যান্ড বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে।
গুগলে যারা ইতোমধ্যে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকটি হলো টেলিকম কোম্পানি অ্যাটিঅ্যান্ডটি এবং ভেরিজন, জনসন অ্যান্ড জনসন, ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট জিএসকে, মার্কস অ্যান্ড স্প্যান্সার, অডি, আরবিএস, ম্যাকডোনাল্ডস, এইচএসবিসি, বিবিসি, চ্যানেল ফোর, দি গার্ডিয়ান ইত্যাদি।
টাইমস এর খবর মতে ভেরিজন এর বিজ্ঞাপন দেখা যেতো ইজিপশিয়ান ওয়াগদি ঘনেইম এর বানানো ভিডিওর সাথে যিনি আমেরিকাতে বহিস্কার হয়েছিলেন উগ্রবাদ প্রচারের অভিযোগে।
এবং হানিফ কোরেয়শি যার কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতা হত্যা করা হয়েছিলো।
যে সব ভিডিওর সাথে এই বিজ্ঞাপনগুলো দেখা যাচ্ছে সেখানে এই বিজ্ঞাপনগুলোতে প্রতি ১,০০০ ক্লিক করলে ছয় পাউন্ড করে পাচ্ছে সেই ভিডিও আপলোডকারী।
এর অর্থ হলো বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের অনিচ্ছাসত্যেও উগ্রবাদীদেরকে অর্থ সহায়তা করছে।
অ্যাটিঅ্যান্ডটি বলেছে, আমরা গভীর উদ্বিগ্ন যে আমাদের বিজ্ঞাপন ইউটিউবের এমন সব কন্ট্যান্টের পাশে দেখা যাচ্ছে যেগুলো সন্ত্রাস এবং ঘৃণা উস্কে দিচ্ছে।
আর যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আমাদেরকে নিশ্চয়তা দিতে না পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা গুগলের নন-সার্চ প্ল্যাটফর্ম থেকে আমাদের বিজ্ঞাপন সরিয়ে নিচ্ছি।
প্রথমে বিজ্ঞাপন বয়কট শুরু হয়েছে ইউকে-তে।
তারপর এই ধাক্কা লাগে আমেরিকাতে।
এক ব্লগ পোস্টে গুগলের চীফ বিজন্যাস অফিসার ফিলিপ সিন্ডলার বলেছেন, এটা সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত। কারন বিজ্ঞাপনদাতা এবং সংস্থাগুলো আমাদের উপর বিশ্বাস রেখেছিলো।
তিনি এজন্য বিজ্ঞাপনদাতা এবং সংস্থার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তাদের বিজ্ঞাপন ঐসব কন্ট্যান্টের সাথে দেখা যাওয়ার জন্য। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা তাদের বিজ্ঞাপন নীতিমালা মেনে চলার জন্য আরো জোড়ালো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে।
কিন্তু এই ক্ষমা চাওয়ার পরও বিজ্ঞাপন বয়কট থেমে থাকেনি। বিজ্ঞাপন বাতিলের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞাপনদাতা কোম্পানির সংখ্যা এসে দাড়িয়েছে ২৫০-টিতে।
বৃটিশ সরকারের সেনাবাহিনী রিক্র্যুটমেন্ট এবং রক্তদান কর্মসূচীর বিজ্ঞাপনও উগ্রবাদী ভিডিওর পাশে দেখা গেছে।
এর জের ধরে বৃটিশ মন্ত্রীপরিষদ অফিস বলেছে, আমরা বুঝতে পারছি ইউটিউব হলো বিপুল জনগণের কাছে সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিজ্ঞাপন মাধ্যম। কিন্তু আমাদের করদাতারা আশা করেন, তাদের অর্থ যেখানে খরচ হবে সেখানে উচ্চমান বজায় রেখে কাজ করা হবে।
অন্যদিকে লেবার এমপি ইভেট কুপার বলেন, গুগলের ক্ষমা চাওয়াই শেষ কথা হতে পারেনা।
তিনি আরো বলেন, তাদেরকে বলতে হবে উগ্রবাদী ভিডিওগুলোতে তাদের যে বিজ্ঞাপন গেছে সেগুলো থেকে তাদের যে আয় হয়েছে সে অর্থ তারা ফেরত দিবে কিনা এবং এখন পর্যন্ত তারা যে অবৈধ ভিডিওগুলো ইউটিউব থেকে সড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে সেজন্য তারা কি পদক্ষেপ নিবে।
এদিকে মিডিয়া এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুগলের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন গুগলের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠছে?
এর উত্তর হলো, বিজ্ঞাপন কোথায় দেখানো হবে, কারা দেখতে পারবে, কোন বয়সের ব্যবহারকারীদের কাছে দেখা যাবে তা অ্যালগরিদম ব্যবহার করে সয়ংক্রিয়ভাবে করা হয়।
এই সয়ংক্রিয় পদ্ধতি ভবিষত-এ আরো বাড়বে বলে প্রযুক্তিবিদরা আশংকা করছেন।
কারন, এখন আমরা এমন একটা বিশ্বে বসবাস করছি যেখানে প্রতিনিয়ত স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে ২.৭ বিলিয়ন স্মার্টফোন ব্যবহার হচ্ছে যেটা ২০২০-তে গিয়ে দাড়াবে পাচ বিলিয়নে।
এই বিশাল স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর কাছে ভবিষত-এ ডিজিটাল ভিডিও প্রচারের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। আর তাদের কাছে বিজ্ঞাপন পৌছে দেওয়ার কাজটা যে অবশ্যই সয়ংক্রিয় হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গুগল অনলাইন বিজ্ঞাপনে একক আধিপত্য বজায় রেখেছে। এবং তাদের এই উৎস থেকে সবচেয়ে বেশি আয় আসে।
২০১৬ সালে তারা অনলাইন বিজ্ঞাপন থেকে ৮০ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে যা তাদের মোট আয়ের ৯০%।
এদিকে এই স্ক্যন্ডাল মিডিয়াতে আসার পর গুগলের শেয়ারের দাম পড়ে গেছে। ব্রোকারেজ বিষেশজ্ঞরা বলছেন, এই ধাক্কার ফলে এই বছর গুগলের মুনাফা কমবে।
তবে গুগলের এই একক আধিপত্য অনলাইন বিজ্ঞাপন জগতে বজায় থাকবে কিনা তা নিয়ে শংকা দেখা দিয়েছে।
ইতোমধ্যেই ভেরিজন ৪.৪৮ বিলিয়ন ডলার দিয়ে আরেক জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন ইয়াহু কিনার জন্য রাজি হয়েছে।
তখন গুগলকে ইয়াহুর সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে।
উল্লেখ্য, গুগলকে যে কয়েকটি ফার্ম সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে তাদের মধ্যে ভেরিজন একটি। সে হিসেবে ভেরিজনের বিজ্ঞাপনও গুগল হারাবে।
সে যাই হোক, সম্প্রতি হোম অ্যাফেয়ার্স কমিটির সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন ফেসবুক, টুইটার এবং গুগল এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
তারা বলেছেন এর ফলে তাদের সুনাম খুবই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এবং তাদের এই বিলিয়ন ডলার আয় যেখান থেকে আসে সেটা যাতে আরো স্বচ্ছভাবে আসে সেজন্য তারা তাদের পলিসি আরো যোগোপযোগী করবে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিতর্কিত ভিডিও শনাক্ত করা এবং সেগুলো সাইট থেকে মুছে ফেলা এমন কোনো ঝটিল কাজ নয়।
যেমন একজন তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে বলেন, উগ্রবাদী ভিডিও দেখার পর তিনি সেটা টুইট বার্তার মাধ্যমে জানান। তারপর সেই ভিডিওটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
এখন সেই সাইটে গেলে দেখা যায় ‘এই কন্ট্যান্ট এই দেশের ডোমেইনে অ্যাভাইলেবল না’।
কিন্তু আরেক ধরনের ভিডিও আছে যেটা বৈধ কিন্তু ইহুদী বিদ্বেষী। ইহুদীদের মিডিয়া, ব্যাংক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে যে আধিপত্য তা নিয়ে তৈরি করা নেতিবাচক ভিডিও।
এখন কোন বিজ্ঞাপনদাতা নিশ্চয় চাইবে না তার কোন বিজ্ঞাপন এই ভিডিও সাথে দেখানো হোক।
এখন এই ইস্যুগুলো গুগল কিভাবে হ্যান্ডল করবে তা দেখার বিষয়।
এইগুলো করে গুগল যে আস্তার জায়গা হারিয়েছে তা কতোটুকু ফিরিয়ে আনতে পারবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তবে মি সিন্ডলার কিভাবে বিজ্ঞাপন নীতিমালা করবেন তার কয়েকটি উপায় বলেছেন।
তারমধ্যে একটি হলো, উল্লেখ্যযোগ্য জনবল তারা নিয়োগ দিবেন যারা বিজ্ঞাপন কোথায় দেখা যাচ্ছে সেটা মনিটর করবেন এবং কিছু নতুন টুলস তৈরি করবেন যা দিয়ে এই বিতর্কিত বিষয়গুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করবেন।
এখন এই যে গুগলের বিরুদ্ধে এতো সমালোচনা হচ্ছে, বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে যার ফলে তারা বলছে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিবে কিন্তু এসবই সময়সাপেক্ষ ব্যপার।
আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক অর্থ। এই জনবল নিয়োগ দিতে হলে গুগলের খরচ অনেক বেড়ে যাবে।
এখন যে রেটে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে তা তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা।
গুগল যে অতিরিক্ত খরচ করবে তার জন্য তারাতো বিজ্ঞাপন রেট বাড়াতে বাধ্য হবে।
এখন বিজ্ঞাপনদাতারা কি এই খরচ মেনে নিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করবে?
এদিকে ইউনিলিভারের চীফ মার্কেটিং অফিসার কেইথ ওয়ীড বলেছেন, আমরা সবাই সস্তায় বিজ্ঞাপন প্রচার করতে চাই। কিন্তু যেটা বলা হচ্ছে তার জন্য অতিরিক্ত পয়সা খরচ করতে হবে।
আর সবশেষে যতো কথাই বলা হোক সব খরচ এসে পড়ে ভোক্তাদের উপর। এই বাড়তি খরচ বহন করতে হবে ভোক্তাদের।
তারা কি এর জন্য প্রস্তুত?