সম্রাট আকবরের সময়ে বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত তাদের খাজনা পরিশোধ করতে পারতেন। তারপরের দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে জমিদাররা কৃষকদেরকে মিষ্টি খাওয়াতেন।
কালক্রমে এর ব্যাপকতা বেড়ে যায় অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে। ব্যবসায়ীরা তাদের বকেয়া আদেয়ের জন্য এই দিনে শুরু করেন হালখাতা উৎসব। তারপর বাংলা নববর্ষে এটিই হয়ে যায় মূল উৎসব।
চৈত্র মাসের শেষদিন যেটা চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে পরিচিত সেদিন সবাই পুরনো জিনিস, যেগুলোর দরকার নেই সেগুলো ফেলে দিয়ে ঘর-বাড়ি পরিস্কার করে থাকেন।
পরের দিন সকালে তারা গোসল করে পরিস্কার জামা-কাপড় পরে ভালো খাবার খেয়ে নতুন বছরের প্রথম দিন শুরু করেন। নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে তারা এই দিন শুরু করেন।
এই ধারা ব্যবসায়ীরাও শুরু করেন। তারা তাদের দোকান পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। পরের দিন দোকান সাজিয়ে ক্রেতাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
যারা সারা বছর ধরে বাকিতে কেনাকাটা করেছেন তারাও এইদিনে পরিস্কার জামা-কাপড় পড়ে তাদের নামের পাশে জমে থাকা বকেয়া টাকা পরিশোধ করতে যান।
সবাই চান নতুন বছরে যেন তার নামের পাশে কোন বকেয়া লেখা না থাকে। এটা অনেকের কাছে একটা সম্মানের বিষয়।
কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে বকেয়া সব টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
সেক্ষেত্রে তারা চেষ্টা করেন সাধ্যমতো যেটুকু পারেন পরিশোধ করার জন্য। একদম পরিশোধ না করা অনেকের কাছেই লজ্জার বিষয়।
যারা বকেয়া টাকা পরিশোধ করতে যান তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাইয়ে আপ্যায়ন করা হয়ে থাকে। তাই এই দিনে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
ব্যবসায়ীরা কার কাছে কতো পাবেন তা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভুল বুঝাবুঝির ভয় থাকে। সেই ভয় থেকেই খাতায় লিখে রাখেন।
সাধারণত লাল কাপড়ে মুড়ানো চিকন লম্বা খাতায় কার কাছে কতো পাবেন তা লিখে রাখেন। নতুন বছরে নতুন খাতায় জের টেনে শুরু করেন নতুন হিসেব।
সময়ের সাথে সাথে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।
এক সময়ের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বেড়িয়ে এসেছে। মানুষ পড়া লেখা করেছে। শহরে এসে চাকরি করছে।
যারা বেশি পড়ালেখা করতে পারেননি তারা জমানো টাকা, ধার করা টাকা বা জমি বিক্রির টাকা দিয়ে বিদেশে গিয়েছেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠাচ্ছেন। মানুষের কাছে টাকা আসতে লাগলো।
তাই অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে হালখাতার গুরুত্বও কমে গেছে।
এর বাইরে, শহুরে জীবনে আস্তে আস্তে মানুষ অব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইংরেজি মাসের শেষে বেতন পাচ্ছেন। খুব দরকার না হলে বাকি নিতে হচ্ছে না। আর মাস শেষে পরিশোধও করে দিচ্ছেন।
এরপর ব্যাংকিং ব্যবস্থার আধিপত্য বেড়ে যায়। ক্রেডিট কার্ড চলে আসে। বাকিতে কেনাকাটা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা টাকা পেয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকের কাছ থেকে।
ব্যাংক ক্রেতার হয়ে টাকা দিয়ে দিচ্ছেন। একটা নির্দিষ্ট সময় পড়ে ব্যাংককে পরিশোধ করে দিচ্ছেন ইংরেজি মাসের হিসেব অনুযায়ী।
এভাবে বাংলা মাসের ব্যবহার আস্তে আস্তে কমতে থাকে। এমনও হয় আজ বাংলা মাসের কতো তারিখ বা কোন মাস চলছে তাও অনেক সময় মনে থাকেনা। আসলে প্রয়োজন না হলে যা হয়।
তবে হালখাতা উৎসব কমে গেলেও এখনো গ্রামে-গঞ্জে এর প্রচলন রয়েছে। পুরান ঢাকাতেও ব্যাপকভাবে হালখাতা পালন করা হয়ে থাকে।
কিন্তু আগে যে লাল কাপড়ে মুড়ানো খাতায় হিসেব লেখা হতো তা অনেক কমে গেছে।
তার জায়গা দখল করে নিয়েছে কম্পিউটার।
হিসেব রাখার সুবিধার জন্য এখন অনেকেই এই ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। এতে করে কার কাছে কতো পাবেন চট করে বের করা যায়।
এবং যার কাছে টাকা পাবেন তাকে মেইল করে বিবরণও পাঠানো যায়।
বড় বড় কোম্পানিগুলো অনেক টাকা খরচ করে তাদের নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকেন।
ইদানিং ছোট ব্যবসায়ীদের জন্যও সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো হালখাতা নামে ডিজিটাল সফটওয়্যার নিয়ে এসেছেন। ব্যবসায়ীরা অল্প টাকা খরচ করেই এই সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন।
লাল হালখাতার জায়গা দখল করে নিচ্ছে ডিজিটাল হালখাতা।
যখন হালখাতা ব্যবহারের প্রচলন হারিয়ে যেতে বসেছে তখন এই বছর রাজস্ব বোর্ড খুব ভালো একটি উদ্যোগ নিয়েছে।
বৃহস্পতিবার চৈত্র সংক্রান্তির দিনে ‘বকেয়া কর আদায় নয়, পরিশোধ’ স্লোগানে প্রথমবারে মতো সারাদেশে ‘রাজস্ব হালখাতা’ আয়োজন করে রাজস্ব বোর্ড। প্রথমবার হিসেবে বেশ সাড়াও পেয়েছে।
সারা দেশে তারা এই রাজস্ব হালখাতা করে মোট ৫৬৬ কোটি টাকা বকেয়া রাজস্ব আদায় করেছে।
দেশের প্রতিটি কর অঞ্চল গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য মাটির হাড়ি-পাতিল, কলা গাছ, কুলো, হাতপাখা, মুখোশ, হাতির গেইট এবং নানা রঙ দিয়ে সাজানো হয়।
আর যারা বকেয়া কর পরিশোধ করতে এসেছেন তাদেরকে মিষ্টি, মোয়া, তিলের খাজা, খৈ, মুড়কি, সন্দশ, কদমা, বাতাসা, বিভিন্ন ধরনের পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের মতো করে আগামী বছর থেকে ব্যাংকগুলো এই দিনে হালখাতা আয়োজন করতে পারে।
ব্যাংকগুলো ইংরেজি বছরের শেষ মাসে তাদের বকেয়া আদায় করার জন্য অনেক তোড়জোড় শুরু করে। কারন এই মাসেই তাদেরকে সারা বছরের হিসেব সমাপ্ত করতে হয়।
অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক-এ আর্থিক বিবরণী দাখিল করতে হয়।
ঋণখেলাপীদের সংখ্যা বেশি হলে বেশি করে কুঋণ সঞ্চিতি রাখতে হয়। যার ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে যায়।
আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও চেষ্ঠা করে থাকে কিছু হলেও বকেয়া কিস্তি পরিশোধ করে তাদের স্টেট্যাস ভালো রাখার জন্য।
ব্যাংকগুলোও যদি বাংলা বছরকে সামনে রেখে কিছু বকেয়া আদায় করতে পারে তাহলে তাদের কুঋণ রাখার পরিমান কমবে।
এই ধারা যদি ভবিষৎ-এ অব্যহত থাকে তাহলে সারা দেশে আবার নতুন করে হালখাতা উৎসব ফিরে আসবে।
বাংলার ঐতিহ্য নতুন করে শুরু হবে।
বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি, মাটির জিনিস, হস্ত শিল্প ব্যবহারের পরিমান বেড়ে যাবে।
হারিয়ে যাওয়া ব্যবসাগুলো আবার ফিরে আসবে।